কলকাতার ফুডপাথ

কলকাতার ফুডপাথ

প্রথম পর্ব

একটা সময় ছিল, প্রায় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, যখন কলকাতার স্ট্রিট ফুড বলতে ছিল বাদাম বা ছোলা ভাজা, মশলামুড়ি, ঝালমুড়ি, আলুরচপ, পেঁয়াজি, ফুলুরি, বাদামের চাক, মাংসের ঘুগনি, আলুর দম বা নিদেনপক্ষে চানাচুর অথবা কুলফি বরফ। তারও আগে, একটু বেলা বাড়লেই, মাথায় কলাইয়ের বড় ডেকচি বা রেকাবি মাথায় হাঁক দিয়ে যেত হরেকরকমের ফিরিওয়ালা। তাদের ঐ বিরাট ডেকচি থেকে বেরিয়ে পড়ত বেলমোরব্বা, সন্দেশ, নারকোলছাপা, ক্ষীর, নাড়ু আর মুড়কির মোয়া। তারপর ১৯৩০'এর আশেপাশে আবিষ্কার হল কাঠি রোল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যদের জন্য কলকাতায় এলো নতুন নতুন খাবার... চাইনিজ চিলি চিকেন, চাউমিন, ফ্রায়েড রাইস। ৫০'এর দশকে দলাই লামা আর তিব্বতিদের কল্যাণে মোমো, থুকপার অনুপ্রবেশ কলকাতার ফুড ম্যাপকে বদলে দিল আমূল। আরও পরে এদেশি কচুরি, সিঙাড়া, চপ, অমৃতির একাধিপত্যে ভাগ বসালেন বিহারি-মারওয়ারি সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীরা। কলকাতায় এল খাস্তা, দইবড়া, ফুচকা, পাওভাজি, ভেলপুড়ি, পাপড়িচাট। আর আজকের দিনে কলকাতায় পাওয়া যায় না এমন স্ট্রিটফুড আদৌ এক্সিস্ট করে কিনা সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে!

এই যে পাড়ার মোড়ে মোড়ে দোকান, স্টল, ঝুপস আর দোকানে দোকানে খাবারের পসরা মিলিয়ে কলকাতার নতুন স্ট্রিট ফুড কালচার, সে সম্পর্কে কিছু বলতে বসলে কলকাতার 'ফুডপাথ'কে বাদ দেওয়া অসম্ভব। কারণ কলকাতার সাথে এ নাম এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হয়ে চলেছে আজ প্রায় ষাট-সত্তর বছর ধরে। তবে আর দেরী কেন? চালাও পানসি এসপ্লানেডের পানে....

আপনি ধর্মতলা থেকে চৌরঙ্গী মোড় ধরে এগোচ্ছেন রাজভবনের দিকে, ডান হাতে মোড়ের মাথায় বিখ্যাত কে.সি.দাস। পাশ কাটিয়ে আরেকটু এগিয়ে, মিনিট পাঁচেক হাঁটলে এসপ্লানেড বাস ডিপোর উল্টোদিকে, পিয়ারলেস হাউসের সামান্য আগে, ডানদিকে একটা সরু গলি ঢুকে গেছে ওয়াটারলু স্ট্রিটের দিকে.... এ গলির পোশাকি নাম জেমস হিকি সরণি (হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই ভাবছেন, এশিয়ার প্রথম সংবাদপত্র 'বেঙ্গল গেজেট'এর প্রতিষ্ঠাতা জেমস অগাস্টাস হিকি'র নামেই এ রাস্তার নাম), কিন্তু আপামর খাদ্যরসিক বাঙালির কাছে এই গলি সুপরিচিত 'ডেকার্স লেন' নামে। এ নামটাও কেমন বিদেশি বিদেশি না? তার পেছনে মূল কারণ হল এই যে আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে কলকাতার কালেক্টর ফিলিপ মিলনার ডেকার সাহেব এই গলিতেই নাবিকদের সাথে খানাপিনা সারতে সারতে দেশ বিদেশের হালহকিকতের খবর নিতেন। তাই ডেকার সাহেবের গলি হয়ে গেল ডেকার্স লেন!
নামকাহন ছেড়ে এবার স্বাদকাহনে ঢুকি। প্রথমেই বলে রাখি, এ গলিতে যদি রেস্টুরেন্টের মতো আরাম আর বাহার চান, তবে কিন্তু ঠকতে হবে। বেশিরভাগ দোকানই অনেকটা টেম্পোরারি স্ট্রিট ফুড জয়েন্টের মতো, বসার জায়গা বলতে এক ফালি বেঞ্চ, বেশিরভাগ সময়েই, বিশেষ করে অফিস টাইমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে হতে পারে; তবে স্বাদ-গন্ধ আর পকেটদুরস্ততায় ডেকার্স লেনের জুড়ি মেলা ভার। রাস্তার একদম মুখে, ডানহাতে, প্রথমেই পড়বে এক মাঝারি সাইজের চায়ের দোকান.... কলকাতার একমাত্র চায়ের স্টল যেখানে ভাঁড় বা কাঁচের গ্লাসের দেখা মেলা ভার, ঝকঝকে সাদা কাপ আর প্লেটে আপনার ফরমায়েশ মতো চা পাবেন... দার্জিলিং চা, আসাম চা, চিনি দিয়ে বা চিনি ছাড়া দুধ চা, কম দুধের চা, ঘন দুধের চা, লিকার চা, পাতা চা, এলাচ চা, আদা চা, লবঙ্গ চা মায় গ্রিন টি যা চাইবেন যখন চাইবেন... সদাহাস্য দোকানি আপনার দিকে বাড়িয়ে দেবে পরম যত্নে.... সাথে কড়া করে সেঁকা বাটার টোস্ট।

চা - টা খাওয়া হলে একটু জিরিয়ে নিয়ে চলুন দু কদম এগিয়ে যাই, যে জন্য এই ডেকার্স লেনে মূলত আসা। তার আগে একটা নাম বলি আপনাদের। চিত্তরঞ্জন রায়। বাড়ি ওপার বাংলায়। কলকাতায় আগমন কিশোর বয়সে, উনিশশো চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকে। প্রথমে মোহনবাগান টেন্টে চায়ের স্টল, সেখান থেকে রাধাবাজার স্ট্রিটে একচিলতে ভাড়ার দোকান। সেই টাকা জমিয়ে ৫০ টাকা সেলামিতে ছোট্ট একটা দোকানঘর কিনে ডেকার্স লেনের 'চিত্তবাবুর দোকান'এর জয়যাত্রা শুরু। একটা গুহার মতো ঘুপচি ঘর আর পাশের একচিলতে কাউন্টার মিলিয়েই আজও চলছে এই দোকান। সেই যে ষাটের দশকে খাবারের স্বাদে অফিসবাবু তথা বাঙালিদের মন জয়ের শুরু, সেখান থেকে ভাইদের হাত ঘুরে, ছেলেদের জমানা শেষে চিত্তবাবুর দোকান এখন ভাইপোর হাতে। কিন্তু এই দোকান আজ কলকাতার স্ট্রিট ফুডের সেরা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার। সে দোকানও আর কেবল চায়ের কাপে বেঁধে রাখেনি নিজেকে। ঘুগনি-টোস্ট, গাজর-পেঁপে-আলু সহযোগে চিকেন বা মাটন স্টু, ফিশ ফ্রাই, ফিশ রোল, চিকেন পকোড়া হয়ে মেনুতালিকার লেটেস্ট হিট খিচুড়ি। মাত্র ৩০ টাকায় খিচুড়ি, তরকারি, পাঁপড়, বেগুনি, চাটনি আর পায়েসের এমন ভরপেট থালি গোটা কলকাতা চষে ফেললেও খুঁজে পাওয়া ভার। চিত্তদার খাবার স্বাদে এবং গন্ধে যেমন অতুলনীয় তেমনি দামের দিক থেকেও অদ্বিতীয়, কাজেই এমন এক দোকানে যে ভিড় উপচে পড়বে সে কথা বলাই বাহুল্য। খাবার অর্ডার করে সামনের পেতে রাখা বেঞ্চে বসে পড়লেই হল, অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার অবসানে যা হাতে পাবেন সেরকম খাবারের জুড়ি মেলা ভার একথা হলফ করে বলাই যায়। গলি দিয়ে আরেকটু এগোলে চিত্তদার-ই সুরুচি হোটেল। ১৯৯৩ সালে শুরু। বসে খাওয়ার ব্যবস্থার সাথেই চাউ, রোল, রাইস আর চিকেনের সমস্ত আইটেম যেমন সহজলভ্য তেমনিই পকেটফ্রেন্ডলি।

খিচুড়িই হোক বা চিকেন স্টু টোস্ট, ভরপেট খাওয়ার পর একটু পানাহার না করলে কি চলে? চিত্তদার দোকান আর আপনজনের মাঝে আছে এক অসামান্য লস্যির দোকান। সেই ওল্ড স্টাইলে লাঠি দিয়ে ঘুঁটে বানানো ভাঁড়ের লস্যি.... আহা... সাথে পেটে জায়গা থাকলে একপ্লেট গাজরের হালুয়া ঘি আর জাফরানের সুবাস আপনাকে পাগল করে দেবেই!! ওহহো, দেখেছ 'আপনজন'এর কথা বলতেই ভুলে গেছি! রাসবিহারি মোড়ের কাছে সদানন্দ রোড চেনেন কি? ওখানেই একটা ছোট্ট এক চিলতে দোকান আপনজন। স্পেশালিটি? ফিস ফ্রাই, বাটার ফ্রাই, কবিরাজি, ফিস ফিঙ্গার, ব্রেসড কাটলেট, ভেজ চপ, চিকেন চপ, চিকেন পকোড়া - লিস্ট থামাতে পারব না। ওঁদেরই একটা শাখা রয়েছে ডেকার্স লেনে। আপনজনের ফ্রাই খাবেন, চাট মশলা ছড়িয়ে, কাসুন্দি মাখিয়ে, কিন্তু গ্যারান্টি দিচ্ছি একটাও বাজে ঢেঁকুর উঠবে না, হাতে তেল লাগবে না একবিন্দুও!!

নেহাত কপাল খারাপ হলে চিত্তদার দোকান বা আপনজনে জায়গা না পেলে, কিংবা যদি আপনার একটু আধুনিক চেহারার কেতাদুরস্থ দোকানই নেহাত পছন্দ হয় তবে গলির মুখে আহেলি এক্সপ্রেসেও ঢুঁ মারতে পারেন অনায়াসে। নয়ত গলির ইতিউতি ধোসা - ইডলি - উত্তাপম, কিংবা চিলি চিকেন ফ্রায়েড রাইস কম্বো -- ডেকার্স লেন আপনাকে হতাশ করবে না মোটেই....

আর তাছাড়া কথাতেই আছে জিভে প্রেম করে যেই জন....

ওহহ, হ্যাঁ, মনে করিয়ে দিই, ম্যাকডোনাল্ড, ওয়াও মোমো, মিওমোর, সুগার অ্যান স্পাইসের যুগেও ডেকার্স লেন গিয়ে চিত্তদার চিকেন স্টু আর টোস্ট না খেলে চিত্রগুপ্তের কাছেও জবাবদিহি করতে হতে পারে.....!!

© অর্পণ শেঠ, ০৩/০৮/২০১৯

তথ্যসূত্রঃ
১. বিভিন্ন নিউজ পেপার রিপোর্টিং
২. গুগল
৩. Food Blog by Mohamuskil aka Indrajit Lahiri
৪. গত দশ বছরে বারে বারে নানান সময়ে ডেকার্স লেনে হানা দেওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

চিত্রঋণঃ গুগল

Comments

Popular posts from this blog