নাদিয়া তোমার জন্য

নাদিয়া মুরাদ বাসঈ তাহা.....



পাতলা ঠোঁট, বাদামি চুলে ঘেরা রোগা লম্বাটে মুখের মাঝে দুই চোখে অতলান্ত বিষাদ আর প্রতিজ্ঞার আগুন পাশাপাশি.... ছোটখাটো চেহারার এই ইয়াজিদি মেয়েটি মাত্র পঁচিশ বছরের জীবনে মানব সভ্যতার নিষ্ঠুর, নিকৃষ্টতম দিকগুলির জ্বলন্ত সাক্ষী। ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া বা সংক্ষেপে আইসিস (আরবী দাঈশ) জঙ্গীগোষ্ঠীর বীভৎস ইয়াজিদি গণহত্যার একজন অন্যতম সার্ভাইভার ও প্রত্যক্ষদর্শী। আইএসের বর্বরতার শিকার হওয়ার পরেও জীবন থেমে থাকেনি তার, বর্তমান সময়ের একজন অন্যতম সেরা মানবাধিকার কর্মী নাদিয়া বিশ্ব জুড়ে ইয়াজিদি জেনোসাইডের প্রতিবাদ ও যুদ্ধক্ষেত্রে সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স বন্ধের অন্যতম প্রধান মুখ। নাদিয়া খ্রিষ্টান বা ইহুদী হলে যতটা অত্যাচারিত হত, ইয়াজিদি হওয়ায় সেই অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল শতগুণ বেশি। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন ওঠে যে কেন এই পাশবিক অত্যাচার আর নিপীড়ন সইতে হল তাকে? ইয়াজিদিরাই বা এই গণহত্যার লক্ষ্য হলেন কেন?

অ-মুসলিমদের ইসলাম খিলাফত দুটি ভাগে ভাগ করেছে, যাদের নবী ও কিতাব আছে তারা 'আহল-এ-কিতাবী'। এদের ইসলাম জিজিয়া কর দিয়ে ইসলামের অধীনে বাঁচার অধিকার দিয়েছে। বাকিরা, অর্থাৎ যারা অগ্নি, মূর্তি ও শয়তানের উপাসক তাদের প্রতি কোনো ছাড় নেই। তাদের পুরুষদের মরতে হবে মুসলমানদের হাতে আর নারীরা হবে হারেমের যৌনদাসী।

ইসলাম মতে, ইয়াজিদিরা শয়তানের উপাসক।

ইহুদী মিথ আদম ও ইভের কাহিনীর এক অংশ থেকে এই ধর্মবিশ্বাসের জন্ম। জিহোবা প্রথমে সাতজন আর্চএঞ্জেল বা ফেরেস্তা তৈরী করলেন। তারপর পৃথিবী থেকে মাটি নিয়ে তৈরী করলেন আদমকে, নিজের প্রশ্বাস থেকে প্রাণ দিলেন তাকে। এরপর সমস্ত ফেরেস্তাকে নির্দেশ দিলেন আদমকে 'সিজদা' দিতে, অর্থাৎ আভূমি নত হয়ে সম্মান জানানো। সবাই এ কথা মান্য করলেও প্রধান ফেরেস্তা সিজদা করতে অস্বীকার করলেন। এরকম গল্প ইহুদী, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মে বর্ণিত আছে। তাদের মতে, এই অস্বীকৃতিতে ঈশ্বর ক্ষিপ্ত হলেন এবং প্রধান ফেরেস্তাকে শয়তান হিসেবে চিহ্নিত করলেন। সে হল মানবজাতির চিরকালীন শত্রু।

ইয়াজিদি ধর্ম গড়ে উঠেছে এর ঠিক উল্টো কাহিনী থেকে। ফেরেস্তা, যাকে ইয়াজিদিরা 'মেলেক তাউস' (পিকক এঞ্জেল) নামে ডাকে, তিনি আদমকে সিজদা করতে অস্বীকার করায় ঈশ্বর খুশি হলেন। কারণ মেলেক তাউসের উৎপত্তি ঈশ্বরের নিজের জ্যোতি থেকে, অর্থাৎ তিনি খোদ ঈশ্বরের অংশ। ঈশ্বরের নিজের অংশ কখনোই মাটির তৈরী মানুষের কাছে মাথা নত করতে পারে না। তারপরও তাউস চল্লিশ হাজার বছর ধরে কাঁদলেন, কারণ ঈশ্বরকে অমান্য করার অভিযোগ তুলে ঈশ্বর তাউসকে পরীক্ষা করছিলেন। পরীক্ষায় খুশি হয়ে তিনি মেলেক তাউসকে মানবজাতির কল্যাণের জন্য একজন পথপ্রদর্শক হিসেবে নিয়োগ করলেন।

ইয়াজিদিদের আরও বিশ্বাস এই যে, আদম ও ইভের প্রথম মিলন হওয়ার আগে মেলেক তাউস তাদের নিজ নিজ দেহরস থেকে আলাদা আলাদা ভাবে জীব সৃষ্টির পরামর্শ দিলেন। তখন আদম ও ইভ তাদের দেহরস পৃথক দুটি জারে পূর্ণ করে মুখ বন্ধ ভাবে রেখে দিল। বহু মাস পরে জার দুটি খোলা হলে দেখা গেল যে, ইভের জারে কীট ও পতঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে, আর আদমের জারে সৃষ্টি হয়েছে এক অপরূপ ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে। এই ছেলের নাম রাখা হল শেহিদ-বিন-জার। শেহিদ-বিন-জার বড় হয়ে এক হুরিকে (পরী) বিয়ে করে এবং তাদের যে সন্তান জন্মায় তারাই ইয়াজিদিদের মূল পূর্বপুরুষ। সুতরাং, ইয়াজিদি বিশ্বাসমতে, তাঁরা শুধুমাত্র আদম থেকে সৃষ্টি হওয়া সন্তানের উত্তরসুরী, অন্যদিকে বাকি সমস্ত মানুষ আদম ও ইভের সন্তান। এই কারণেই ধর্মীয় পরিচয়কে ইয়াজিদিত্বের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ধরা হয়। এ এমন এক ধর্মবিশ্বাস যা শুধুমাত্র জন্মসূত্রেই লাভ করা সম্ভব। বহিরাগত কারোর পক্ষে ইয়াজিদি ধর্মের অনুসারী হওয়া সম্ভব নয়। এমনকি নিজেদের মধ্যে কেউ অন্য ধর্মের বা বহিরাগত কাউকে বিয়ে করলেও তাদের আর ইয়াজিদি ধর্মানুসারী হিসেবে গণ্য করা হয় না। তারা তখন ধর্মচ্যুত অ-ইয়াজিদি হিসেবেই পরিগণিত হয়।

আদম এবং ইভ মিলে যখন বংশবিস্তার করে পৃথিবী ভরিয়ে ফেলল তখন চারদিকে চরম বিশৃঙ্খলা, পাপ, মারামারি আর অনাচারে ভরে গেল। মালেক তাউস সেই অনাচার থেকে পৃথিবীকে মুক্তি দিতে 'নিসান' মাসের (আসিরিয় ও হিব্রু ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস, গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের এপ্রিল) প্রথম বুধবার পৃথিবীতে নেমে এলেন। তিনি নবীদের মতো করেই সত্যপথের কথা বললেন। ইয়াজিদিরা সেই সত্যপথে চলা এক ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। আর মালেক তাউসের অনুগামী হওয়ার কারণেই ইয়াজিদিদের ইহুদী, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মে শয়তানের উপাসক বলা হয়। অন্যেরা মুখে বলে ঠাণ্ডা থাকলেও ইসলাম খিলাফত তরবারির শক্তিতে বিশ্বাস করে। তাই নবী মহম্মদের ইসলামি খিলাফত চালু হওয়ার পর বিভিন্ন খলিফার শাসনে হাজার বছর ধরে এই ইয়াজিদিরা নির্যাতিত হয়ে আসছেন। যদিও এই ধর্মপ্রাণ সম্প্রদায় অন্যান্য ধর্মের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ও শান্তিপ্রিয়। তুরস্কে আর্মেনিয়ান খ্রিষ্টানদের গণহত্যার সময়ে ইয়াজিদিরা খ্রিষ্টানদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ধর্মীয় দিক থেকে ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের সাথে তাদের নৈকট্য আছে। নবী ইব্রাহিমকে ইয়াজিদিরাও নবী বলে এবং ইব্রাহীমের পুত্র কুরবানী দেওয়ার ঘটনার স্মরণে ইয়াজিদিরাও উট কুরবানী দেয়। ইয়াজিদিরা দৈনিক পাঁচবার প্রার্থনা করে, তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের নাম ঈদ-আল-জামাহ। চেনা চেনা মনে হচ্ছে? ভাববেন না তারা নকল করেছে কারণ ইয়াজিদিদের ধর্মীয় ক্যালেন্ডারের বয়স প্রায় ছ'হাজার বছর। গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা, কুর্দিশ ভাষায় কথা বলা এই সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা বর্তমানে পাঁচলাখের আশেপাশে; যার মধ্যে উত্তর ইরাক, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক'ই ইয়াজিদিদের প্রধান বাসভূমি।

নাদিয়ার কথা বলতে গিয়ে ইয়াজিদিদের কথা বলতে বসার কারণ খোদার নামে দঈশ-ই খোদকারী করা, বিশ্ব জুড়ে ইসলামি খিলাফত স্থাপনের ডাক দেওয়া, সন্ত্রাসবাদী-জিহাদী-মুজাহিদ আইসিস জঙ্গীসংগঠন ইয়াজিদিদের ওপর চরম নিপীড়ন চালাবে এ সহজেই অনুমেয়, কারণ তারা শয়তানের উপাসক। তাদের পুরুষদের দেখা মাত্র হত্যা, নারীদের যৌনদাসী আর অতিরিক্তদের নিলামে তুলে বিক্রি করে দেওয়া হবে সৌদী, কুয়েতের মুসলিম এজেন্টদের হাতে......

২০১৪ সালে ইরাক ও সিরিয়া জুড়ে ইসলামিক স্টেটের বাড়বাড়ন্ত শুরু হলে তারা প্রথমেই মসুল ও তেল-আফর অঞ্চলসহ গোটা ইরাকের শিয়া মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের দুটি অপশন দেয়। হয় বিশাল টাকা চাঁদা দাও নয়ত ঐ জায়গা ছেড়ে চলে যাও। কিন্তু ইয়াজিদিদের ক্ষেত্রে কোনো আপোস করতে আইএস নারাজ।

উত্তর ইরাকের সিঞ্জর প্রদেশে মাউন্ট সিঞ্জর ঘেরা রুক্ষ্ণ ও শুষ্ক পার্বত্য এলাকায় বেশিরভাগ ইয়াজিদিদের বাস। মূল জীবিকা কৃষিকাজ ও পশুপালন। সাধারণ খেটে খাওয়া অধিকাংশ গরীব মানুষগুলির বড় বড় বাড়ি ছিল না ঠিকই কিন্তু মাটির আর পোড়া ইঁটের বাড়িতে সুখ আর শান্তি ছিল। এরকমই এক ছোট্ট গ্রাম কোচো। সাকুল্যে হাজার বারোশ মানুষের বাস। এই গ্রামেই ১৯৯৩'এ নাদিয়া মুরাদের জন্ম। বাবা মারা গেছেন সেই কোন ছোটোবেলায়, নাদিয়ার তেমন মনেও পড়ে না বাবাকে। মা আর ভাই বোন দাদা বৌদি ভাইপো ভাইঝিদের নিয়ে সুখে দুঃখে কোনক্রমে দিন কেটে যায় তার। আর পাঁচটা সরল সাদাসিধে গ্রাম্য মেয়ের মতোই সাধারণ জীবন নাদিয়ার, ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখত বড় হয়ে ইতিহাসের শিক্ষক হবে সে। ছোট্ট নাদিয়া তখন দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি মাত্র একুশ বছর বয়সেই জীবনটা বদলে যাবে আমূল.... তছনছ হয়ে যাবে গোটা জীবনের যাবতীয় ভালোটুকু..... বেঁচে থাকতেই সাক্ষাত জাহান্নম দর্শন হয়ে যাবে তার......

আইসিস বর্বরতার খবর পৌঁছনোর পরই আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে ইয়াজিদি মানুষজন পালিয়ে মাউন্ট সিঞ্জরে আশ্রয় নিলেও কোচো থেকে সিঞ্জর পর্বতের দূরত্ব অনেক, ফলে এই গ্রামের বাসিন্দাদের পক্ষে পালানো সম্ভব ছিল না। কোচো সংলগ্ন বেশকিছু গ্রামে হত্যালীলা চালানোর পর আইএস জঙ্গীরা কোচোয় এসে পৌঁছয়। তারা প্রথমেই সরাসরি সংঘাতে যায়নি, কারণ তা হলে পৈশাচিক বর্বরতার নিক্তি কিছুটা কম পড়ে যেত বটে। জঙ্গীরা গ্রামটিকে প্রথমে চারদিক থেকে ঘিরে নেয় যাতে একজন গ্রামবাসীও নজর এড়িয়ে পালাতে না পারে। তারপর গ্রামের প্রধানের কাছে বার্তা পাঠানো হয়। কী ছিল সেই বার্তায়? সোজাসাপটা ভাষায় বলা হয় গোটা গ্রামের সমস্ত ইয়াজিদিদের ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে হবে, অন্যথায় মৃত্যু। ধর্মপ্রাণ ইয়াজিদিদের কাছে ধর্মত্যাগ আর মৃত্যু সমান, কাজেই আইসিসের মতো বর্বরদের প্রপোজাল মেনে নেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। গ্রামের প্রধান নানাভাবে সাহায্যলাভের, বাঁচার রাস্তা খোঁজার মরিয়া চেষ্টা চালালেও কুর্দিস্তানের লোকাল গভর্নমেন্ট বা ইরাক সরকার, কোথাও কোনো সাহায্যের নূন্যতম প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যায়নি।

এরপর ২০১৪'র ১৫ই অগাস্ট, ঠিক যখন গোটা ভারত স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে রত, সেই সময় ভারত থেকে মাত্র হাজার চারেক কিলোমিটার দূরের কোচো গ্রামে ঢুকে পড়ে সশস্ত্র আইএস জঙ্গীর দল। অস্ত্র উঁচিয়ে, ভয় দেখিয়ে গোটা গ্রামবাসীদের এনে ফেলা হয় গ্রামের মাঝের বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরে। গ্রামবাসীদের পাহারা দিতে জনাপাঁচেক জঙ্গী সেখানে থেকে যায়। বাকিরা বন্যার জলোচ্ছ্বাসের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে; যেখানে যতটুকু সোনা দানা, দামী জিনিসপত্র, টাকাপয়সা ছিল, সব অবাধে লুঠ করে নিয়ে একে একে আগুন ধরানো হয় প্রতিটি বাড়িতে, দলের পাণ্ডা কড়া নজর রাখে গোটা লুঠতরাজ পর্বে, যাতে একটা বাড়িও বাদ না পড়ে যায়। এরপর মহিলা ও বাচ্চাদের দল থেকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের একমাত্র হাইস্কুলের দো'তলায়। হাইস্কুলের মূল দরজায় বসে কড়া পাহারা, পাহারায় ভয়াল দর্শন তিনজন আইএস জঙ্গী, প্রত্যেকের হাতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, সকালের রোদ পড়ে ঝকঝক করছে। গ্রামের বাকি পুরুষদের ঐ প্রান্তরেই পিছমোড়া করে হাত বেঁধে লাইন করে দাঁড় করানো হয়। তারপর? জঙ্গীদের অটোমেটিক কালাশনিকভ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছিটকে গিয়ে একঘন্টায় ঝাঁঝড়া করে দেয় তিনশো বারো জন ইয়াজিদি পুরুষকে! হাইস্কুলের দো'তলার জানলা থেকে এই ভয়ঙ্কর নরমেধ যজ্ঞ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে বাধ্য করা হয় নাদিয়াসহ সমস্ত ইয়াজিদি মহিলা ও শিশুদের। তবে মুখে টুঁ শব্দটি করারও যো ছিল না কারোর। শব্দ শুনলেই জানলা বরাবর ধেয়ে যায় সার সার বুলেটের ঝাঁক। মুখ বুজে, স্তব্ধ আতঙ্কে শিহরিত হতে হতে ক্রুর, পৈশাচিক কাণ্ডকারখানা প্রত্যক্ষ করে ইয়াজিদি নারীরা.... নির্বাক, নিস্পন্দ দলটির চোখের জল বাঁধ মানে না, অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত অপরিসীম শোকে, দুঃখে আর ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় তাদের। দিনের শেষে আইএস জঙ্গীদলের নৃশংস গণহত্যার শিকার হন কোচো গ্রামের প্রায় সমস্ত পুরুষ, সংখ্যায় ছ'শো, যার মধ্যে নাদিয়ার ছ'জন ভাইও ছিল। নাদিয়ার অন্য তিন ভাই ভয়ঙ্কর আহত হলেও সেই ক্যাওসের মাঝে কোনোরকমে জঙ্গীদের নজর এড়িয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। একদিনের মধ্যে গোটা কোচো গ্রামকে পুরুষশূন্য করে এবার আইএস জঙ্গীদের নজর গিয়ে পড়ে মহিলা ও শিশুদের ওপর।

হাইস্কুলের দো'তলায় যে শ'তিনেক ইয়াজিদি মহিলা ও শিশুদের বন্দী করে রাখা হয় তাদের মধ্যে যাদের বয়স পাঁচ বা তারও কম, তাদের জঙ্গীরা নিজেদের সাথে নিয়ে যাবে বলে স্থির হয়। কিন্তু কী করা হবে ঐটুকু ছোট্ট শিশুগুলোর সাথে? ওদের ঠিকানা আইএস জঙ্গী প্রশিক্ষণ শিবির, সেখানে ওদের মগজ ধোলাই হবে, ইসলামের নামে, খিলাফত প্রতিষ্ঠার মহান কর্তব্যের নামে তৈরি হবে সুইসাইড স্কোয়াড.... তারপর কোনো আত্মঘাতী হামলায়, গাড়ি বোমা বা অন্য বিস্ফোরণে শত শত ছিন্ন ভিন্ন লাশের মাঝে পড়ে থাকবে ওদের শান্ত নিথর দেহ!

বাকি ইয়াজিদি নারী ও বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের হাত বেঁধে একটি বাসে ওঠানো হয়। কোচো থেকে বাস ছেড়ে চলে আসে সোলাঘ বলে একটি জায়গায়। সেখানে বাস থামিয়ে টেনে হিঁচড়ে আশিজন মহিলাকে বাস থেকে নামানো হয়, প্রত্যেকের বয়স পঁয়তাল্লিশ বা তার বেশি। তারপর আবারও চলে নৃশংস হত্যালীলা। নাদিয়ার মা সহ একে একে আশিজন ইয়াজিদি রমণী জঙ্গীদের গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আপনারা হয়ত ভাবছেন, এই আশিজনকে আলাদা করে হত্যা করার কারণ কী? আরে বাবা বয়স্কা মহিলাদের দিয়ে ক্রীতদাসত্ব করানো বা যৌনসেবাদাসী করার মধ্যে কোনো লাভ আছে কি? কে কিনবে বুড়িগুলোকে? কে টেনে নিয়ে যাবে বিছানায়? অতএব, এই 'স্পয়াল অফ ওয়ার'দের মেরে ফেলাই সমীচীন।

এবার শ'তিনেক টাটকা, তাজা নারীমাংস নিয়ে বাস চলল মসুল শহরের উদ্দেশ্যে, ইরাকে আইসিস হেডকোয়ার্টার এই মসুল শহর। গোটা যাত্রাপথে ভয়ার্ত, স্তব্ধবাক ইয়াজিদি মেয়েদের ওপর চলল লাগাতার নির্যাতন..... তাদের জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেড়ে দিয়ে গোটা শরীরের যত্রতত্র হাত বোলানো চলল..... মুখে ঘষে দেওয়া হল দাড়ি.... মুচড়ে দেওয়া হল স্তনবৃন্ত! ঘন্টাকয়েকের নারকীয় বাসযাত্রার শেষে বাস এসে থামল মসুল সদর দপ্তরে। অবশ্য ইয়াজিদি মেয়েদের নরক যন্ত্রণার অবসান হল না। এই তো সবে শুরু.....

মধ্যযুগে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট বসত পড়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু আধুনিক যুগে এমন বর্বর প্রথার কথা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। ইসলামিক স্টেট তাদের ঘাঁটিতে এমনই এক স্লেভ মার্কেটের সূচনা করেছিল ২০১৪'র শুরুতে। পণ্য? কচি, নধর, ভার্জিন নারীদেহ। আইসিস মুখপত্র 'দাবিক' ম্যাগাজিনে চলত তার ঢালাও বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন দেওয়া হত ফেসবুক, টেলিগ্রামের মতো সোশাল মিডিয়ায়। উদ্দেশ্য বিকৃতমনস্ক ফিঁদায়েদের নারীশরীরের লোভ দেখিয়ে দলে টানা এবং দুনিয়াজোড়া দেহব্যবসার মার্কেটে সাপ্লাই দিয়ে জঙ্গী তহবিল গড়ে তোলা। এই স্লেভ মার্কেটের মূল পণ্য ছিল ইয়াজিদি মেয়েরাই, কারণ এই তথাকথিত কাফেরদের দিয়ে বাধ্যতামূলক সেক্স স্লেভারি করানোটা জিহাদিদের পরম পূণ্যের কাজ। গোটা ইরাক ও সিরিয়ার প্রায় ছ'হাজার সাতশো হতভাগ্য ইয়াজিদি নারী আইসিসের হাতে বন্দিনী হয়ে এই স্লেভ মার্কেটে চালান হয়। নয় থেকে চল্লিশ বছর বয়সী এই মেয়েরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গণধর্ষণের শিকার হয়, তারপর খিদে মিটে গেলে 'গিফট' করে বা বেচে দেওয়া হত তাদের। দাম? কখনও কখনও মাত্র কুড়ি ডলার!!

যেসমস্ত ইসলামিক স্টেট জঙ্গীরা জিহাদী পুরস্কারস্বরূপ এই সমস্ত নারীদের ভোগ করার অধিকার পাবে তাদের জন্য আইএস বিশেষ পুস্তিকার ব্যবস্থা করেছিল, সেই পুস্তিকায় ছিল বিস্তারিত গাইডলাইন, প্রশ্নোত্তরে সাজানো ছিল ডু'স অ্যান্ড ডোন্ট'স.... দাবিক আর ফেসবুকেও পাওয়া যেত সেসব প্রশ্ন-পুস্তিকা.... এরকম দু একটা প্রশ্নোত্তরের নিদর্শন তুলে ধরা যাক আপনাদের সামনে.....

Q19. Is it permissible to beat a female slave?
A: It is permissible to beat a female slave as a form of discipline.

Q 13. Is it permissible to have intercourse with a female slave who has not reach puberty?
A: Yes. However if she is not fit for intercourse, then it is enough to enjoy her without that.

Q 6. Is it permissible to sell a female captive?
A: It is permissible to buy, sell or gift a female captive and slave for they are merely property.

পড়তে পড়তে রাগে, ঘৃণায়, ক্ষোভে শিউরে উঠলেন তো? হ্যাঁ, এমনও হয় জিহাদের নামে! আমরা তবু লজ্জায় মুখ ঢাকতে ভুলে যাই!

প্রতিদিন মসুল শহরে সন্ধে নামলেই তামাম জিহাদীদের শারীরিক রসনা তৃপ্তির জন্য এই স্লেভ মার্কেটের দ্বার উন্মুক্ত হয়। মার্কেটের একতলায় রিসেপশন কাউন্টার, একে একে জিহাদীরা এসে জড়ো হচ্ছে সেই বাড়ির নিচে। তারপর নাম লিখিয়ে, রেজিস্ট্রেশন করে বাড়ির দো'তলায় যাওয়ার ছাড়পত্র মিলছে তাদের। সিঁড়ি বেয়ে দো'তলায় উঠে লম্বা টানা বারান্দার দুদিকে বড় বড় চারটে হলঘর, সবক'টা হলঘরের দরজায় সশস্ত্র পাহারা, আর ভেতরে শয়ে শয়ে ইয়াজিদি ক্রীতদাসী, সবমিলিয়ে প্রায় হাজারখানেক, যাদের বয়স নয় থেকে ত্রিশ বা বত্রিশ। ভীত, সন্ত্রস্ত এই মেয়েদের মধ্যে বেশিরভাগই অবসন্ন দেহে মেঝেয় লুটিয়ে পড়ে রয়েছে। মোটা মোটা লোহার শিকলে সার দিয়ে তাদের হাত বাঁধা, খাওয়া জোটেনি বহু ঘন্টা, ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি, বমি, প্রস্রাব মিলিয়ে নরক গুলজার অবস্থা। জিহাদীরা আসছে.... একা একা বা দলবেঁধে.... কর্কশ গলায় প্রথমেই আদেশ 'উঠে দাঁড়া কাফেরের দল'। সে আদেশ না মানলেই ভারী মিলিটারি বুটের লাথি আছড়ে পড়ছে ওদের গায়ে-মাথায়-কোমরে-পাঁজরায়। তারপর আমি বা আপনি যেমন বাজারে গিয়ে পেট টিপে টাটকা না বাসি বুঝে মাছ কিনি সেভাবেই একে একে ইয়াজিদি মেয়েদের গায়ে, স্তনে, পায়ের ফাঁকে হাত বুলিয়ে বুঝে নেওয়া হচ্ছে কতটা টাটকা, কতটা নরম, কতটা লোভনীয় এই নারীমাংস.... মুখে শুধু একটাই প্রশ্ন 'ভার্জিন তো?' তারপর যাকে পছন্দ হল প্রথমেই তার পেটে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হচ্ছে, কারণ? 'to mark her as sold.' এরপর হাতের বাঁধন খুলে টেনে হিঁচড়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে লাথি মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে নিচে। সেখানে কার সাথে কোন মেয়ে যাচ্ছে সেসব আদ্যোপান্ত লেখা হলেই নির্দিষ্ট মুজাহিদটি পেয়ে যাবে মেয়েটির পূর্ণ অধিকার।

নাদিয়া মুরাদও ছিল সেদিনের সেই হাজারখানেক হতভাগ্য ইয়াজিদি মেয়েদের একজন। তাকে যে মুজাহিদ পছন্দ করে তার দৈত্যের মতো আকৃতি দেখেই ভয়ে নাদিয়ার বুক হিম হয়ে যায়। নিচে যখন নাম ধাম লেখা হচ্ছে তখন সে দেখে পাশ দিয়ে আরেক হিজাদি এগোচ্ছে গুটিগুটি পায়ে, এর চেহারা একটু বেঁটেখাটো, রোগা রোগা। যার সাথেই যাক চরম নিপীড়ন আর রেপ হওয়া তো আছেই কপালে, তবু ঐ দৈত্যের হাতে একবার পড়লে ছিন্নভিন্ন, ক্ষতবিক্ষত হতে বেশি সময় লাগবে না..... এসব ভেবেই নাদিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল ঐ রোগা লোকটার পায়ে, সে যেন তার সাথেই নিয়ে যায় নাদিয়াকে। লোকটাও কী মনে করে রাজি হল, নাদিয়াকে নিয়ে তুলল তার খাস ডেরায়। এই মুজাহিদ গণিমত অনুযায়ী ছিল একজন পাক্কা জিহাদী, নামাজী মুজাহিদ, রীতিমত রাতের নামাজ পড়া শেষ করে নাদিয়াকে টেনে নিত বিছানায়। তার আগে ইয়াজিদি হওয়া সত্ত্বেও নাদিয়াকে বাধ্য করত মুসলমানদের মতো নামাজ পড়তে। না পড়লে কপালে জুটত বেদম প্রহার আর সিগারেটের ছ্যাঁকা। প্রতিদিন, প্রতিরাতে নাদিয়াকে সে বাধ্য করত ভালো ভালো জামাকাপড় পরে, মেকআপ করে আসতে 'in preparation of an ideal rape!'

দুঃসহনীয় প্রতিটা মুহূর্তেও ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস হারায়নি নাদিয়া মুরাদ। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে গেছে অমানুষিক নিপীড়ন আর নিগ্রহের সাথে। আর সুযোগ খুঁজেছে কী করে এই শয়তানের ডেরা থেকে পালানো যায়! বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগহীন, মোবাইলহীন, সাহায্যের নূন্যতম প্রত্যাশাহীন একটা মেয়ে, শত শত অন্য ইয়াজিদির মতোই স্রেফ ভাগ্যের হাতেই সঁপে দিয়েছিল নিজেকে। একদিন এভাবেই পালাতে গিয়ে বাড়ির গেটের কাছে রক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে গেল নাদিয়া। কাফের মেয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়লে সে তখন 'spoil of war' ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন মেয়ের সাথে কী করা যায়? সে শাস্তিবিধানও আছে আইএস গাইডলাইনে। নাদিয়াকে টেনে নিয়ে যাওয়া হল একতলার এক অন্ধকার কুঠুরিতে, বন্দী করে রাখা হল, তারপর সে রাতে পালিয়ে যাওয়ার শাস্তিস্বরূপ গণধর্ষণ করা হল.... নাদিয়ার নিজের কথায় 'then I was brutally gangraped, two at a time, untill I fell unconcious.'

কিছুদিন পর, গিফট হিসেবে হাতবদল হয়ে যায় নাদিয়া। এই দ্বিতীয় মুজাহিদ একাই থাকত তার ডেরায়। একদিন সন্ধের মুখে সে বেরোয় নাদিয়ার জন্য ভালো পোশাক কিনতে, কারণ আবারও হাতবদল হবে তার, ভালো পোশাক না পরলে, রঙচঙে প্যাকেটে মুড়ে না দিলে, ভালো দাম পাওয়া যাবে কি করে? বেরনোর সময় মনের ভুলে দরজা খুলে রেখে চলে যায় সে। দেরী করেনি নাদিয়া.... শয়তানের জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে বাড়ির পিছনের অন্ধকার রাস্তা ধরে ছুটতে ছুটতে চলে আসে মসুল হাইওয়ে। ফাঁকা হাইওয়ের ধারে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে যা থাকে কপালে মরেছিই তো ভেবে সেই বাড়িতে ঢুকে পড়ে সে। কোনোরকমে বলতে পারে নিজের দুঃসহ যন্ত্রণার কাহিনী। হাতে পায়ে ধরে সাহায্য চায়, বাঁচার নিদারুণ আর্তিটুকু তুলে ধরে বাড়ির বাসিন্দাদের কাছে। নাদিয়ার ভাগ্য এবার আর তাকে বিমুখ করেনি, বাড়িটি ছিল এক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের, কিন্তু আইসিসের সাথে তাদের কোনো যোগ ছিল না৷ তারা রাজী হয় নাদিয়াকে সাহায্য করতে। কালো বোরখায় আপাদমস্তক ঢেকে, ইসলামিক আইডি'র সাহায্যে কোনোরকমে বর্ডার পার করিয়ে দেয় নাদিয়াকে। আইসিসের হাতে ধরা পড়ার তিন মাস বাদে আবারও মুক্ত পৃথিবীতে শ্বাস নেওয়ার বিলাসিতাটুকু করতে পারে নাদিয়া।

এ পর্যন্ত পড়ে আপনারা হয়ত দুঃখে, ক্ষোভে, রাগে আর চরম হতাশায় ভেঙে পড়ছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন ভেঙে পড়েনি ঐ বাচ্চা মেয়েটা, সামান্য শারীরিক নিগ্রহও যেখানে মানসিকভাবে ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার করে দেয় আমাদের, সেখানে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস লাগাতার পাশবিক শারিরীক ও মানসিক অত্যাচারের দগদগে ক্ষত শরীরে ও মনে বয়ে নিয়েও হাল ছাড়েনি সে। ধরার পড়ার আগে বা পরে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অন্য ইয়াজিদি মেয়েদের মতো একবারও আত্মহননের কথা ভাবেনি নাদিয়া। নৃশংস গণহত্যার শিকার হয়েছে তার গোটা পরিবার, ছোটোবেলায় বাবাকে হারানো বাচ্চা মেয়েটার কাছে তার বড় দাদা ছিল বাবার মতো, আইসিস জঙ্গীদের নিষ্ঠুরতায় দ্বিতীয়বার পিতৃহারা হয়েছে সে, তার তিন বৌদি, দুই ভাইঝি তখনও আইসিস হারেমখানায় বন্দিনী। সে নিজে স্থান পেয়েছে ডাহুক আর রোয়াঙ্গার রিফিউজি ক্যাম্পে। তবু প্রতি মুহূর্তেই তার মনে হয়েছে কিছু একটা করতে হবে, এই নৃশংস অপরাধের বিচার চাইতে হবে, উদ্ধার করতে হবে বৌদি এবং ভাইঝি সহ আরও তিন হাজার সাতশ নিরপরাধ ইয়াজিদি মেয়েদের। গোটা বিশ্বে জুড়ে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ঢেউ না তুলতে পারলে এই বর্বরদের কিছুতেই থামানো সম্ভব নয়!

ক্যাম্পে থাকার সময় নাদিয়া এক বেলজিয়ান সংবাদপত্রকে অকপটে খুলে বলে তাদের দুর্দশার কথা। এরপর এক রিফিউজি রিলিফ প্রোগ্রামের হাত ধরে নাদিয়া চলে আসে জার্মানীতে। সেখানে তার পরিচয় হয় বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও আন্তর্জাতিক আইনজীবী আমাল ক্লুনির সাথে। দুজনে মিলে শুরু করেন 'আওয়ার পিপল্ ফাইট' নামের আন্দোলন, মি টু হ্যাশট্যাগেরও বহু আগে। ২০১৫'র ১৬ই ডিসেম্বর ইউনাইটেড নেশনস্ সিকিউরিটি কাউন্সিলে গোটা ইরাক ও সিরিয়ায় হয়ে চলা হিউম্যান ট্র্যাফিকিংয়ের বিষয়ে বক্তব্য রাখে নাদিয়া মুরাদ। তাঁর ও তাঁর মতো হাজার হাজার ইয়াজিদিদের ওপর ঘটে চলা বর্বরতার কাহিনী শুনে শিউরে ওঠে গোটা বিশ্ব..... তার বক্তৃতার শেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের সেই কনফারেন্স হলে উপস্থিত প্রতিটি শুভবুদ্ধিপন্ন মানুষের চোখ ভিজে ওঠে.... দৃশ্যতই চোখ মুছতে দেখা যায় তাবড় বিশ্বনেতাদের। ইউ এন অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের সভায় নাদিয়ার সাথে বক্তব্য রাখেন আমাল ক্লুনি, আইএসের এই জঘন্য জেনোসাইড, রেপ ও হিউম্যান ট্র্যাফিকিংকে ''bureaucracy of evil on an industrial scale" হিসেবে বর্ণনা করে তিনি ইউএন সিকিউরিটি কাউন্সিলের কাছে দাবী করেন, "to order a formal investigation on the ground with a proper budget to excavate mass graves and collect DNA and other documentary evidence such as certificates of slave ownership."


 মূলত নাদিয়া ও আমালের লাগাতার প্রচেষ্টায় ইউনাইটেড নেশনস্ বাধ্য হয় আইসিসের বিরুদ্ধে ইয়াজিদি জেনোসাইডের চার্জগঠন করতে। ২০১৬'য় রাষ্ট্রপুঞ্জ নাদিয়াকে "Goodwill Ambassador for the Dignity of Survivors of Human Trafficking" হিসেবে নিযুক্ত করে। ইউনাইটেড নেশনসের হয়ে নাদিয়া বারবার ছুটে যায় ইরাক, সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের শ'য়ে শ'য়ে রিফিউজি ক্যাম্পে.... সেখানে ইয়াজিদিসহ অন্যান্য হিউম্যান ট্র্যাফিকিং সার্ভাইভারদের সাথে কথা বলে, তাদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী শুনে হাল না ছাড়ার, লড়াই চালিয়ে যাওয়ার বার্তা দেয়। গোটা বিশ্বজুড়ে জেনোসাইডের শিকার হওয়া প্রতিটি হতভাগ্যের সমর্থন ও সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে শুরু করে 'নাদিয়া'স ইনিশিয়েটিভ' নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

এখানেই শেষ নয়, নিজের ও নিজের কমিউনিটির কথা তুলে ধরে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা প্রচারের উদ্দেশ্যে নাদিয়া ইউরোপ, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও আরব দেশগুলির সংসদ ও রাষ্ট্রনেতাদের সাথে দেখা করে প্রতিটি রাষ্ট্রশক্তিকে এই আন্দোলনে সামিল হওয়ার আবেদন জানায়। সারা বিশ্বের ধর্মোন্মাদ উড বি আইসিস জঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠায় নাদিয়া মুরাদ..... "My message to young men and women who wish to join Daesh (IS) is that they should know that we risked our lives to escape from Daesh. They killed our men and women and raped us and did many heinous things beyond most people's imagination. Before you join Daesh for religious and other reasons, you should know you will either be killed or you will loose your humanity. I appeal to those young men and women who are thinking to join Daesh, just look at what we have had to do to escape and how hard we are working to free our people still held captive by Daesh."


২০১৭'য় তার লেখা "Nadia Murad: The Last Girl: My Story of Captivity, and My Fight Against the Islamic State" বইয়ের মাধ্যমে তুলে ধরে তার নিজের কথাঃ

"I was a farmer, a villager, and I was born to be such. I had hopes, common to all young girls of my village. I was not raised to give speeches. Neither was I born to meet world leaders nor to represent a cause so heavy and so difficult.
We were killed and raped brutally, by the divine right, according to Daesh, but Daesh does not represent Islam. It uses Islam to justify its crime. I would like to ask muslim country leaders and muslim community to stand with me and speak out against this distortion of their religion.
I want serious action, not just words. I want International protection to be provided to our ethnic community. Rescue our girls and women and recognize it as Yazidi Genocide. There are thousands missing and twenty seven mass graves discovered only in North Iraq, they have not been looked yet. In camps, there are thousands of hungry people. Also want them (Daesh) to face court, face justice, being prosecuted in International Criminal Court. If ICC can't prosecute the world's most evil terror group, what is it there for?
I don't have much information about world politics, but there are things I want from all the world and all the governments, and from all human who will hear my voice: that we all stand together, from all religions and all countries. Whatever happens we all are human and we all are the same. That we take a stand for conscience and humanity, to cut off these things happening to us today so that this will not happen to other people, so that it will not happen to other children, women and girls, and to eradicate this terrorism from the world......"

নাদিয়ার অকৃত্রিম সাহস আর মানবসেবায় অগ্রণী ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তাকে ২০১৬ সালে 'শাখারভ পুরস্কার'এ ভূষিত করে। যুদ্ধক্ষেত্র এবং সশস্ত্র সংঘাতের হাতিয়ার হিসেবে যৌনতা ও যৌন বর্বরতা বন্ধের সপক্ষে জোরালো সওয়াল করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিরোপাও আজ তার মাথায়। ১৯০১ থেকে ২০১৮, ১১৮ বছরের ইতিহাসে ১০৬ জন ব্যক্তি ও ২৪টি সংস্থা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তবু অকুণ্ঠ চিত্তে, নির্দ্বিধায় বলতে পারি নোবেলও আজ সম্মানিত হল, নাদিয়াকে সম্মান দিতে পেরে।

অনাথ-রেপ ভিক্টিম-সেক্স স্লেভ-রিফিউজি...... মাত্র পঁচিশ বছরের জীবনে নাদিয়া অতিক্রম করে গেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরমতম প্রতিটি পর্যায়কে। তবু হেরে যায়নি সে, ভেঙে পড়েনি একবারও। দুঃসহ যন্ত্রণার কথা যখন সে বলে ব্যথাহত অথচ কঠোর মুখে, বক্তৃতার মাঝে যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে বারবার, তখন অবিশ্বাস্য মনে হয় তার বেঁচে ফেরা আর লড়াইয়ের কাহিনী। তবুও বিশ্বাস করুন, এই একটিবারের জন্য, বিশ্বের প্রতিটি কোণায় অত্যাচারিত মেয়েদের জন্য, পাচার হওয়া, দাসীবৃত্তি করতে ও যৌনদাসী হতে বাধ্য হওয়া অগণিত মেয়ের প্রতিভূ হয়ে, তাদের খুঁজে আনতে, বাঁচাতে, তাদের কথা বলতে এগিয়ে আসা, তাদের লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া এই নাদিয়ার কথা লিখতে গিয়ে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে..... অব্যক্ত ব্যথায় আটকে যাচ্ছে আঙুলের প্রতিটি ক্লিক..... কান্নায় বুজে আসছে গলা....


কুর্নিশ-সেলাম-স্যালুট এসব শব্দও আজ বড় ক্লিশে, বড় অসহায় নাদিয়ার কাছে। এরপর যখনই আমরা হার না মানার কথা বলব, লড়াইয়ের কথা বলব, যন্ত্রণার কথা বলব, ভেঙে না পড়ার কথা বলব, শুভবুদ্ধি-শুভচিন্তা-মানবিকতা-বিশ্বশান্তির কথা বলব, বলব জীবনের গল্প তখন প্রতিটি বার, প্রতিটি শব্দে একসাথে উচ্চারিত হবে একটাই নাম.....

নাদিয়া মুরাদ বাসঈ তাহা।।

তথ্যসূত্রঃ
১. Hard Talk on BBC with Nadia Murad.
২. https://amp.theguardian.com/commentisfree/2018/oct/06/nadia-murad-isis-sex-slave-nobel-peace-prize
৩. Nadia Murad: The Last Girl: My Story of Captivity, and My Fight Against the Islamic State
৪. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Nadia_Murad
৫. https://www.nobelprize.org/prizes/peace/2018/summary/
৬. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yazidis
৭. https://nadiasinitiative.org

Comments

Popular posts from this blog

কলকাতার ফুডপাথ